চরফ্যাশনের মুজিবনগর চরে জমি দখলে প্রভাবশালীদের অত্যাচার

তেঁতুলিয়ার বুক চিরে বয়ে যাওয়া জলরাশির মাঝে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে একটি সবুজ দ্বীপ। সেখানে কয়েক হাজার লোকের বসবাস। ওই দ্বীপই তাদের জীবিকার উৎস। এটা ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার দুলারহাট থানার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর মুজিবনগর।

এ চরের বেশিরভাগ পরিবার দৌলতখান উপজেলার নদী ভাঙন কবলিত। সরকার ১৯৫৯ সালে নদী ভাঙ্গনে প্রায় ২ হাজার অসহায় পরিবার ভূমিহীন হয়ে পরায় পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ওই চরে প্রত্যেক নদী সিকস্তি পরিবারকে ৩ একর করে জমি বন্দোবস্ত দেন।

২০১০ সালের পর থেকে তাদের এসব জমি দখলে নিতে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা অসহায় পরিবারের ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। ইতোমধ্যে ভূমিদস্যুদের হামলা-মামলার শিকার হয়ে শত শত পরিবার ওই চর থেকে ঘর বাড়ি ফেলে রেখে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি জমি দখল করতে রাতের আধাঁরে এসব পরিবারের ওপর হামলা, কুপিয়ে জখম ও হত্যাকান্ডের মত ঘটনাও ঘটেছে এ চরে। বর্তমানে ওই চরের বাসিন্দাদে মধ্যে দখল আতঙ্ক বিরাজ করছে। অসহায় পরিবারগুলোকে হামলা-মামলা ও নির্যাতন করে করে তাদের বসতভিটা ও ভোগদখলীয় জমি অবৈধভাবে দখলে নিতে একটি প্রভাবশালী ভূমিদস্যু চক্র সক্রিয় রয়েছে। ভূমিদস্যুদের জমিদখল আতঙ্কে চরের বাসিন্দারা অসহায় হয়ে পড়েছে। দখল আতঙ্কে হাজারো পরিবার উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চরাঞ্চলের ভূমিদস্যু হারুন দেশপালি’র নেতৃত্বে, নুরুল ইসলাম, মনির হোসেন, ফারুক, ইউপি সদস্য মোহাম্মদ নবীসহ কয়েকজন প্রভাবশালী ভূমিদস্যু ভূয়া ম্যাপ তৈরি করে চরাঞ্চলের অসহায় পরিবারের ভোগদখলীয় জমি জোর করে দখল নিয়ে স্বনামে-বেনামে জমির মালিকানা তৈরি করে অন্যের ভোগদখলীয় জমি দখল করে নিচ্ছে। ওই চক্রের হামলা-মামলার শিকার হয়ে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত । কারো কারো বসতভিটা ও চাষের জমি দখল করে নেওয়ায় এখন তারা ঠিকানাহারা।

জানা যায়, মুজিবনগর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মৃত মোফাজ্জল ইসলামের ছেলে মোঃ খোকন। নদী সিকস্তি ওই পরিবারটি সুখেই ছিলো। নদীতে মাছ ধরে ও কৃষি কাজ করে স্বাচ্ছন্দে চলছিলো খোকনের পরিবার। বছর দু’য়েক আগে ভুমিদস্যুদের মিথ্যা মামলা শিকার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগের এখন সে মুক্ত। কিন্তু জেলে থাকায় অবস্থায় ভূমিদস্যুরা ভূয়া কাগজ তৈরি করে তার ৯ একর জমি দখল করে নেয়। জামিনে মুক্ত হয়ে খোকন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তার জমি উদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। জমি-জমা হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে খোকন ও তার পরিবার।

খোকন জানায়, ভূমিদস্যুরা তার চাষের জমি দখল করেই থেমে যায়নি, তাকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করতে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। ভুমিদস্যু হারুন ২ হাজার থেকে ২১’শ, ২৪শ’ থেকে ২৫’শ দাগে ভুয়া ম্যাপ তৈরি করে খোকনের ৯ একর জমি দখলে নিতে তার বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা দায়ের করেন। মিথ্যা মামলায় খোকন দেড় বছর ধরে জেল খাটেন। খোকন জেলে থাকা অবস্থায় জমি দখলে গেলে এতে খোকনের পরিবারের সদস্যরা বাধাঁ দিলে তাদেরকে কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে তারা স্থানীয় হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন। এদিকে ৯ একর জমির সব ফসল লুট করে নিয়ে যায় ভুমিদস্যু হারুন বাহিনী।

চরাঞ্চলের অসহায় নির্যাতিত খোকন আরও জানায়, বর্তমানে আমার ঘর বাড়িসহ ৩ একর জমি আমার দখলে রয়েছে। ওই জমি দখলে নিতেও হারুন বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছে। ওই জমি দখলে নিতে আমার স্কুল-পড়ুয়া মেয়েকেও আসামী করে আদালতে মামলা দায়ের করেছে। মামলা থেকে রক্ষা পায়নি আমার স্ত্রী সন্তানও। বর্তমানে আদালতে আমার বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আমি জেলে থাকা অবস্থায় আমার জামিনের খরচের জন্য বাড়ী থেকে কিছু গাছ বিক্রি করেন আমার স্ত্রী। ওই গাছগুলোও হারুন বাহিনী জোর করে নিয়ে যান। তিনি চরাঞ্চলে সাংবাদিক পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

তিনি জানান, আমার ক্রয়কৃত ৯ একর জমির যে মালিকানা লোক দেখিয়ে জমি দাবি করেন হারুন বাহিনী তারা সবাই চরফ্যাসন উপজেলার ১৫নং নজরুল নগর ইউনিয়নের বাসিন্দা বলা হয়েছে।

এ বিষয় তিনি ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের সাথে যোগাযোগ করলে তারা কেউই ওই এলাকার বাসিন্দা নয় বলে একটি প্রত্যায়ন পত্র তাকে দেন। মূলত হারুন বাহিনী এ চরে ভুয়া ম্যাপ তৈরি করে মামলা-হামলা করে চরাঞ্চলের অসহায় পরিবাগুলোর জমি দখলে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

তিনি এ নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন যার মামলা নং ০৭/২০১৯।

অন্যদিকে এ চরের বাসিন্দা মোঃ কামাল, মোঃ ইউনুস, কৈলাশ চরণ বিশ্বাস, আবদুল মোতালেব তাদের কাছ থেকেও মামলা হামলার মাধ্যমে তাদের ভোগদখলীয় জমি জোর করে দখল করে চর ছাড়া করেছেন এ চক্র। তারাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ ভুয়া ম্যাপ বানানো চক্রের বিচার দাবী করেন।

এদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে হারুন জানান, আমরা কারো কোনো জমি দখল করিনি।

এ বিষয়ে মুজিবনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল ওদুদ জানান, এ ঘটনায় দুলারহাট থানায় মামলার পর বিচার চলমান রয়েছে। যারা এ জমির সঠিক কাগজপত্র দেখাতে পারবে তাদেরকে এ জমি বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কেউ কারো জমি দখল করেনি।

এ ব্যাপারে চরফ্যাসনের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা আমার জানা নেই। যদি কেউ আমার কাছে আসে, তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।