বাসর রাতে ‘অনার কিলিংয়ের শিকার’ শিক্ষক মনির?

বাসর রাত, নববধূর হাতের মেহেদির রংও শুকায়নি তখন

জঙ্গিরাষ্ট্র পাকিস্তানে প্রায়ই ‘পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে অনার কিলিং’-এর ঘটনা নিউজের শিরোনাম হলেও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের প্রচলন তেমন একটা নেই বললেই চলে। তবে দ্বীপজেলা ভোলায় সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা সামনে এসেছে, যা ‘অনার কিলিং’ কিনা তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে।

গত ২০ আগস্ট ভোলায় বাসর রাতে এক স্কুল শিক্ষকের মৃত্যু হয়। পরিবারের বরাতে বেশকিছু সংবাদমাধ্যমে শুরু থেকে বিষয়টিকে আত্মহত্যা বলা হলেও পুলিশ এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলেনি। তারা তখন আইনের মধ্যে থেকেই এ বিষয়ে কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন। তবে এখনও পরিবারের সদস্যদের সন্দেহজনক আচরণের কারণে ‘অনার কিংলিং’য়ের প্রসঙ্গ উঠে আসছে।

‘অনার কিলিং’ কী?
বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবারের সদস্যদের অসম্মানের কারণ হতে পারে, এমন কাজে জড়িত থাকার দায়ে একই পরিবারের কোনো সদস্যকে হত্যা করার প্রথা ‘অনার কিলিং’।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, যেসব কারণে সাধারণত অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, সেগুলো হলো:

  • পরিবারের ইচ্ছায় বিয়েতে অসম্মতি,
  • যৌন সহিংসতা অথবা ধর্ষণের শিকার হওয়া,
  • বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে জড়ানো বা শুধুমাত্র সেরকম সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ।

তবে এসব কারণ ছাড়াও হত্যার ঘটনা ঘটার নজির রয়েছে। পোশাক পরার ক্ষেত্রে অসঙ্গতি অথবা অবাধ্য ব্যবহার করার অভিযোগেও হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু ভোলার স্থানীয়রা বলছেন, স্কুল শিক্ষক মনিরের বিয়েতে তার পরিবারের কেউ রাজি ছিল না। অর্থাৎ শিক্ষক মনির তার পরিবারের অসম্মতিতে বিয়ে করেছেন, যদিও বিয়েটা পারিবারিকভাবেই হয়েছিল।

কী ঘটেছিল সেদিন?
পরিবার ও স্থানীয়দের বরাতে ২১ আগস্ট বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে এসেছিল বাসর রাতে এক স্কুল শিক্ষকের মৃত্যুর কথা।

ওই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, ‘মনিরের সঙ্গে ভোলা পুলিশ লাইন এলাকার মাহে আলমের মেয়ে বিবি জয়নবের বিয়ে হয়। এরপর ধুমধাম করে কনেকে তার পিতার বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে আনা হয়। রাতে বিয়ের সব আয়োজন শেষে বর-কনেকে বাসর ঘরে দেওয়া হলে ওই রাতেই ঘরের সামনের আড়ার সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে মনির। পরে, ভোরে ডেকোরেটরের লোকজন বাড়িতে আসলে মনিরের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়।’

তবে এই সংবাদের বিরোধিতা করে সেদিন থেকেই ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয় স্থানীয় মানুষ। তাদের দাবি, ‘বাসর রাতে স্কুল শিক্ষক মনির আত্মহত্যা করেননি। তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।’ এসব পোস্টে পুলিশের নির্বিকার থাকার অভিযোগও করা হয়।

স্কুল শিক্ষক মনির

তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে যে, বাসর রাতে তাহলে স্কুল শিক্ষক মনিরকে কে বা কারা হত্যা করেছে? তার শত্রুইবা কারা?

স্কুল শিক্ষক খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ভোলা জেলা শহরে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচিও পালন করা হয়। এসব কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

এমন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গণমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন না আসায় এ বিষয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন করে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেল। ওই টেলিভিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে এক বিস্ময়কর তথ্য।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নববধূ জয়নব বলেন, বাসর রাতে একটু আসছি বলে মনির বাইরে বের হয়। অনেকক্ষণ হয়ে গেলে তাকে খোঁজ করি। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি প্রেম করে বিয়ে করলেন, তিনি অনেক সাধনার পর আমাকে পেয়েছে এটাও তিনি বলেছেন। তাহলে কী কারণে তিনি আত্মহত্যা করবেন? এত টাকা খরচ করে তিনি বিয়ে করেছেন কি আত্মহত্যার জন্য? আর তার মৃত্যুর পর অজ্ঞান হওয়া আমার জ্ঞান ফেরার আগেই তার ভাই-বোনরা মিলে কেন আমাকে মারধর করলো? কেন আমাকে দেয়া গয়নাগুলো তারা আমার থেকে ছিনিয়ে নিলেন? কত নিচু হলে মানুষ এমন কথা বলে!’

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ওই টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধি কথা বলেছেন নিহত মনিরের ভাইয়ের সঙ্গে। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকেই নিহত মনিরের ভাই ও পরিবারের সদস্যদের আচরণ ছিল সন্দেহজনক। এমনকি এ বিষয়ে কোনো কথাই বলতে চাননি নিহত মনিরের ভাই এনামুল হক সবুজ।

নিহত মনিরের ভাই সবুজ বলেন, তার মৃত্যুর বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। পুলিশ তদন্ত করছে তারা এ বিষয়ে জানে। আপনাদের কিছু জানার থাকলে প্রশাসনের কাছে জিজ্ঞেস করেন।

তবে স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, শুরু থেকেই এ বিয়েতে মনিরের পরিবারের কেউ রাজি ছিল না। তাই বাইরের কেউ নয়, বিয়ের রাতে ওয়াশরুমে নিয়ে পরিবারের লোকজনই মনিরকে হত্যা করেছে। ওয়াশরুমে ভাঙচুরের আলামত পাওয়া গেছে। এসব আলামত পাওয়ার পরও পুলিশ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না?

পরিবারের লোকজন টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করছে বলেও অভিযোগ করেন তারা। তাদের দাবি, একজন মানুষ আত্মহত্যা করলে যে লক্ষণগুলো স্বাভাবিকভাবে থাকে, এমন কোনো চিহ্ন মনিরের বেলায় ছিল না।

স্কুল শিক্ষক মনিরের মৃত্যু নিয়ে এসব অভিযোগ উঠলেও ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, তদন্ত সঠিক পথেই এগোচ্ছে।

অন্যদিকে ঘটনার শুরুর দিকেই ভোলা সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ছগির মিঞা বলেছিলেন, ‘এটি কি হত্যা না আত্মহত্যা তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। নিহত শিক্ষকের বাড়ি থেকে সকল আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি জিনিস খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লাশ ময়না তদন্তের জন্য ভোলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া, নিহত স্কুল শিক্ষকের নববধূসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’