বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের স্মৃতির প্রতি কেন অযত্ন-অবহেলা?

একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ। এর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মহান স্বাধীনতা। এর মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী হিসেবে ৭ জনকে দেওয়া হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব। এদেরই একজন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল।

জন্মস্থান দ্বীপজেলা ভোলা হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দরুইন গ্রামে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন ৪র্থ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের এই বীর সিপাহী। সেই দরুইন গ্রামেই অনেকটা অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি।

বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে। তার পিতা হাবিবুর রহমান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ছিলেন। শৈশব থেকেই দুঃসাহসী হিসেবে খ্যাত ছিলেন মোস্তফা কামাল।

সৌভাগ্যই বলতে হবে এ কারণে যে, আমার জন্মস্থানও বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের স্মৃতি বিজড়িত সেই ভোলা জেলায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- প্রাথমিকে থাকাবস্থায় পাঠ্যবইয়ে মোস্তফা কামালের বিষয়ে অল্পকিছু ধারণা হলেও এই বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে জেলা পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ভোলা জেলা প্রশাসন কিংবা সরকারের অন্য কোনো অংশের কোনো কর্মযজ্ঞ দেখিনি।

এই মহান বীরশ্রেষ্ঠকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কোনো আয়োজন আমি দেখিনি। আমার দেখা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ বিষয়ে ছিল নির্বিকার। তারা তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বীরশ্রেষ্ঠ’র আদর্শকে ছড়িয়ে দেয়ার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাও করেননি।

১৮ এপ্রিল মহান এই বীরশ্রেষ্ঠ’র শাহাদাত বার্ষিকী। বাড়ি থেকে পালিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া মোস্তফা কামাল ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রুর সামনে থেকে পালিয়ে না গিয়ে বরং সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হন।

মুক্তিযোদ্ধা সেনারা যখন পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় বিহ্বল হয়ে পড়েন, কয়েক জন শহীদ হয়ে গেলেও মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। তার পূর্ব দিকের সৈন্যরা পেছনে সরে নতুন অবস্থানে সরে যেতে থাকে এবং মোস্তফাকে যাবার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি সরে যাননি। বরং সহযোদ্ধাদের সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগের জন্য মোস্তফা পূর্ণোদ্যমে এল.এম.জি থেকে গুলি চালাতে থাকেন।

এমনকি তার ৭০ গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি। এতে করে শত্রু রা তার সঙ্গীদের পিছু ধাওয়া করতে সাহস পায়নি। দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে একসময় গুলি শেষ হয়ে গেলে, শত্রুর আঘাতে তিনি লুটিয়ে পড়েন।

মোস্তফা কামাল শহীদ হওয়ার পর সেখানেই কয়েকদিন তার মরদেহ পড়ে ছিলো। পরে গ্রামের পরিস্থিতি শান্ত হলে স্থানীয়রা এসে মোস্তফা কামালকে পুকুরের অপর পাড়ে সমাহিত করেন। দুঃখের বিষয় হলো- ভোলা জেলা প্রশাসন সেখান থেকে আজও তার মরদেহ নিজ জন্মস্থানে আনতে পারেনি। কিংবা আনার প্রয়োজন বোধ করেননি।

১৮ এপ্রিল এই বীরশ্রেষ্ঠ’র শাহাদাত বার্ষিকী হলেও এবারও ভোলা জেলা প্রসাশনের তেমন কোনো আয়োজন নজরে আসেনি। জাতীয় পর্যায়েও নেই কোনো আয়োজন। অথচ এই বীরশ্রেষ্ঠদের অসীম সাহস আর জীবনের বিনিময়ে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ।

ভোলা জেলা মুক্তিযুদ্ধের আরেক কিংবদন্তির জন্মস্থান। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য তোফায়েল আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক অনেক আগে থেকেই ভোলার রাজনৈতিক নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি অনেকবার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের অন্যতম নীতিনির্ধারক তিনি। অথচ তারই সময়ে একজন বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতি এভাবে অযত্ন অবহেলায় থাকবে, তা ভাবতেই কষ্ট হয়। তিনি এ বিষয়ে নতুন করে নজর দেবেন বলে আশা করি।

এছাড়া বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামালকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তার দেশপ্রেম, অসীম সাহস এবং বীরত্বগাঁথা তুলে ধরতে হবে। তার নামে জেলা শহরে একটি বাস টার্মিনাল এবং একটি নামেমাত্র জাদুঘর করেই দায় সারার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। এই বীররা যদি অযত্ন অবহেলার কারণে আমাদের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান, তাহলে এরচেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কিছু থাকবে না।

বর্তমানে ধর্ষণসহ নানা অনাচার এবং অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এর বেশিরভাগ শিকার তরুণ প্রজন্ম। উচ্চ আদালতও বলছেন, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এসব ঘটছে। এই নৈতিক অবক্ষয় ঠেকাতে শুধু মোস্তফা কামাল নয়, সব বীরশ্রেষ্ঠ এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার বিকল্প নেই। তাহলেই দেশপ্রেমের নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই প্রজন্ম গড়ে তুলবে নতুন বাংলাদেশ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভোলা প্রতিদিন এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)