মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এম. জাকির

নুরুল আমিন

লালমোহনের মতো মফস্বল এলাকা থেকে উঠে আসা আত্মপ্রত্যয়ী এক সাংবাদিকের নাম এম. জাকির হোসেন। সে গ্রামের ছেলে। তার বাড়ি লালমোহন উপজেলার ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের আবুগঞ্জ এলাকায়। গ্রামের ছেলে হলেও সাংবাদিকতায় তার কৌশল ও পারদর্শিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তার নিউজ লেখার দক্ষতা ও তথ্য সংগ্রহের অভিনবতা তাকে অনেক উচ্চতায় টেনে তুলেছে। সাংবাদিকতায় গভীর আন্তরিকতা ও সততা তার জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। সে কখনও সরেজমিনে গিয়ে আবার কখনও সোর্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করত। তার হাতে আসা তথ্য খুব যাচাই করত। সে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করার জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে দৌড়ঝাঁপ করতো। কখনও সে ম্যানেজ প্রক্রিয়ার কাছে হার মানত না এবং নিজেকে বিকিয়ে দিত না।
সাংবাদিকতা ছিল জাকিরের নেশা এবং পেশা। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে তার আন্তরিকতা ছিল। ছোটবেলা থেকেই সাংবাদিকতার প্রতি তার অদম্য আগ্রহ ছিল। মানুষের উপকার হয় এবং ভুক্তভোগী লোকজন আইনী সহায়তা পেতে পারে এ ধরনের নিউজ করত। সাধারণ নিউজের পাশাপাশি অনুসন্ধানী নিউজ লেখায় জাকির ছিল সিদ্ধহস্ত। সে উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমস্যা, সম্ভাবনা ও নানারকম অসঙ্গতির চিত্র তার প্রতিবেদনে তুলে ধরত। দুঃসময়ে নিরীহ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সে তাদের সহযোগিতা করত। বয়স কম হলেও তার সাংবাদিকতার পরিধি ছিল বিস্তৃত। সত্য উদঘাটনে সে মরিয়া হয়ে কাজ করত। তার ছিল বলিষ্ঠ নীতি ও আদর্শ। পেশার প্রতি আন্তরিকতা ও দায়িত্ব পালন তাকে যেমন বড় করেছে তেমনি অবিস্মরণীয় করেছে। সাংবাদিক এম. জাকির হোসেন নেই কিন্তু তার আদর্শ তাকে অমর করে রেখেছে। ২০০৮ সালের ২৯ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় জাকিরের মৃত্যু হয়। গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তার কর্মের মধ্য দিয়ে সে আজও বেঁচে আছে।
জাকিরের হাত ধরে লালমোহনে সাংবাদিকতার পরিধি যেমন বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি বিকাশ লাভ করেছে। সাংবাদিকতা ছিল জাকিরের সাধনা। অল্প সময়ের ব্যবধানে জাকির দক্ষ সাংবাদিক হিসেবে গড়ে ওঠে। মফস্বল এলাকা থেকে শুরু করে জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সে তার লেখনীর জাদুময় পরশে মফস্বল এলাকার চিত্র যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। এতে সে অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে।
লালমোহন উপজেলাসহ ভোলা জেলার অন্যান্য উপজেলার তৎকালীন অফিসারদের সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সকল দপ্তরেই তার সুসম্পর্ক ছিল। এমনকি এমপি, মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, সমাজ কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, প্রশাসন, সহকর্মী, সাধারণ মানুষ ও জেলা প্রশাসকের সাথেও তার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তখন জেলা প্রশাসক ছিলেন সেকান্তর আলী মণ্ডল। মাঠ পর্যায়ে সোর্সদের সাথে তার সখ্যতা ও বিশ্বস্ততা ছিল অন্যরকম। যার ফলে সে খবরের ভেতরের খবর সংগ্রহ করতে পারত। তার সহজ সরল বন্ধুসুলভ আচরণ সবাইকে মুগ্ধ করত। তার বাচনভঙ্গি ছিল খুব সুন্দর। সম্পর্ক তৈরিতে জাকির খুব পারদর্শী ছিল।
সবাইকে কাঁদিয়ে সাংবাদিক জাকির চলে গেল না ফেরার দেশে। সে যেমন দক্ষ সাংবাদিক ছিল, তেমনি দক্ষ সংগঠক ছিল। তার হাতে বিকশিত হয়েছে লালমোহন প্রেসক্লাব। সৃষ্টি হয়েছে অনেক সংবাদকর্মী। লালমোহনের সাংবাদিকতা বলতেই এম. জাকির হোসেন এবং এম. জাকির হোসেন বলতেই লালমোহনের সাংবাদিকতা। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে লালমোহনে সাংবাদিকতায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। তার মৃত্যুর পর তার মহৎকর্ম কথা বলে। সহকর্মী সাংবাদিকদের হৃদয়ে তার স্মৃতি অম্লান। প্রতি বছর লালমোহন প্রেসক্লাবে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় জাকির হোসেন স্মরণে স্মরণসভা ও দোয়া অনুষ্ঠান করা হয়।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনসহ সাংবাদিকতার বিভিন্ন কলাকৌশল লালমোহনের সাংবাদিকরা তার কাছ থেকে পেয়েছে। সে জেলা সদরে প্রায় প্রতিদিন সকালে যেতো রাতে ফিরে আসত। লালমোহনে সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এম. জাকির হোসেন। শুধু তাই নয়, সে সারা বাংলায় মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। সাংবাদিকদের জন্য সে একটি আদর্শ। তার দেখানো পথে চলতে পারলে সাংবাদিকদের পথচলা সহজ এবং সুন্দর হবে আশা করি।

লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি, নাট্যকার, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। লালমোহন, ভোলা। nurulamin911@gmail.com, 01759648626.