কারাগারের ভেতর কি খুনের সংস্কৃতি চালু হচ্ছে?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন অপরাধী কিংবা নিরাপরাধ ব্যক্তি যেকোনো কারণে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে যখন কারাগারে পাঠানো হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয় গ্রেপ্তার ব্যক্তি নিরাপদ।

সুরক্ষিত কারাগারের এই সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাল্টে দেয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর, জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যার মাধ্যমে। বিশ্ব ইতিহাসেই সে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।

সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা না চললেও সম্প্রতি কারা অভ্যন্তরে এমন দু’টি ঘটনা ঘটেছে যা সুরক্ষিত কারাগারের ইতিহাসের সঙ্গে বেমানান। এর একটি ঘটেছে গত ২৯ মে চট্টগ্রাম কারাগারে, আরেকটি তার আগে গত ২৬ এপ্রিল পঞ্চগড় জেলা কারাগারে। চট্টগ্রামে নিহত হয়েছেন যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ অমিত মুহুরী, আর পঞ্চগড়ে মারা গেছেন পলাশ কুমার রায় নামের এক আইনজীবী।

চট্টগ্রাম কারাগারে অমিত নিহত হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে তার ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের কাহিনী। একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিষয়ে এমন সংবাদ স্বাভাবিক। এটা ভেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষ তৃপ্তির ঢেঁকুরও তুলছেন এ ভেবে যে, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীর এমন করুণ মৃত্যুই প্রাপ্য। পাপ বাপকেও ছাড়ে না।’

সাদা চোখে বিষয়টাকে স্বাভাবিক ঘটনা মনে হবে। কিন্তু বিষয়টা মোটেই তা নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় অমিত মুহুরীর ছোট ভাই অনিক মুহুরীর একটি ভিডিও বার্তা অনেকের কাছে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

নিহত সন্ত্রাসী অমিত মুহুরীর ভাই অনিক মুহুরী

ভারত থেকে দেওয়া ওই ভিডিও বার্তায় অনিক বলেন: ‘চট্টগ্রাম কারাগারে পরিকল্পনা করে অমিত মুহুরীকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করে নাটক সাজানো হয়েছে।’

অনিকের প্রশ্ন: ‘অমিতের মুখ অর্ধেক শেইভ করা কেন? অমিত তো জীবনে কখনোই অর্ধেক শেভ করেনি। আর রাতের বেলায় কারাগারে শেভের সময় না। কারা অভ্যন্তরে শেভের সময় দুপুরে। তাহলে কি তাকে দুপুরে খুন করে রাতের কথা বলা হচ্ছে? তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর কেন তাকে বাইরের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে? আগে কেন নেওয়া হলো না? আর জেলের ভেতরে ইট কোথা থেকে আসে?’

অনিকের দাবি: ‘ঘরের মধ্যে বসে পরিকল্পনা করে কোটি টাকায় প্রশাসনকে হাতে নিয়ে ছয়-সাত জন মিলে অমিত মুহুরীকে খুন করা হয়েছে।’

অনিকের এসব প্রশ্ন একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। অমিতের বাবাও বিষয়টিকে পরিকল্পিত খুন বলছেন। তিনি জানিয়েছেন: ‌‘মৃত্যুর আগে অমিত বলেছিল, তাকে হত্যার পরিকল্পনা হচ্ছে। তাকে খুন করতে কারাগারে লাখ লাখ টাকার অফার আসছে।’

এমনটাই জানা গেছে চট্টগ্রামের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘চট্টগ্রাম প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত খবরে। ওই প্রতিবেদনে প্রকাশিত তার পিতা অরুণ মুহুরীর ভাষ্য অনুযায়ী: ‘কিন্তু অমিত জানতো। অমিত নিজেই বলেছে, আমাকে মেরে ফেলবে। ওখানে লাখ লাখ টাকার অফার আসছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য পরিকল্পনা করছে। আমাকে অন্য জেলখানায় হস্তান্তর করা হোক।’

অমিত মুহুরীর খুনি রিপন নাথ

তিনি বলেছেন: ‘কিন্তু আমরা ওইটা আমল করিনি। আমরা ওইটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। ওকে কে মারবে? ও এমন কী হয়েছে যে ওকে মেরে ফেলবে? কিন্তু কোটি টাকা নাকি ওর জন্য ঢালবে। এ রকম অফার অন্যজনের কাছে গেছে। এটা অমিতের কানে গেছে। ওর কথাগুলো আমরা বুঝতে পারিনি। কানেও নেইনি।”

এটা ঠিক যে অমিত মুহুরী চট্টগ্রামের একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিল। তার শত্রুপক্ষ থাকবে এটাও স্বাভাবিক। আইনি প্রক্রিয়ায় সে তার অপরাধের সর্বোচ্চে শাস্তি পাবে এটা সবার কাম্য। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাকে কারাগারে খুন করে ফেলা হবে। সে যত বড় অপরাধী হোক না কেন, কারাগারের মতো সুরক্ষিত স্থানে তাকে খুন করে ফেলার মতো বিষয় কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির ফেসবুক স্ট্যাটাস করুণ সত্য তুলে ধরেছে। অমিতের মৃত্যুর পর ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন: ‘‘…কথাগুলো শুধু অমিতের জন্যই বলছি না। অমিতের ঘটনা খুনের বদলে খুন নাকি রাজনৈতিক রোষানলে খুন এটাই ভাবনার বিষয়!

যদি রাজনৈতিক কারণে খুন হয়ে থাকে তবে আমরা কোনো দলের নেতাকর্মী জেলে আর নিরাপদ নই। কারণে অকারণে আমাদের জেলে যেতে হয়। আমরাও খুন হয়ে যেতে পারি! কোনো দেশের আইনে এমনকি কোনো ধর্মীয় আইনেও চার দেয়ালে ‘বন্দী’ অবস্থায় হত্যার স্বীকৃতি নেই।

এরপরেও এ যদি জেলের করুণ দৃশ্য হয় তবে বলতে হয় চট্টগ্রাম কারাগারের নাম গুয়েন্তানামো কারাগার রাখা উচিত।”

নুরুল আজিম রনির এই বক্তব্যের সাথে অনেকেই একমত। এখানে শুধু বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী কিংবা অমিতের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীর মৃত্যুর বিষয়টি জড়িত নয়। বরং কারা অভ্যন্তরে তাদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যদি এই ভয়ঙ্কর প্রথা চালু হয়, তাহলে নিরাপরাধ রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক বন্দীদের বেলায়ও এসব ঘটবে, যা কখনোই কাম্য নয়।

আরেকটি বিষয় হলো- নিহত অমিত মুহুরীর নিহত হওয়ার পর তার বাবা এবং ছোট ভাইয়ের কথায় উঠে এসেছে তার জামিনের কথা। তাদের ভাষ্য মতে, অমিত মুহুরী ইতোমধ্যে তিনটি মামলায় জামিন পেয়েছিল। আর দুটি মামলায় জামিন পেতে হয়তো কিছুদিন সময় লাগতো। ১১ তারিখ ছিল কারাগার থেকে তার বের হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ। সে বের হলে হয়তো কোনো পক্ষের সমস্যা হতো এ কারণেই তাকে খুন করা হয়েছে।

শঙ্কার বিষয় হলো- শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে এই অমিতের উত্থান কিন্তু যুবলীগের হাত ধরে। সে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের নেতা ছিল। কেন্দ্রীয় যুবলীগের একজন নেতার অনুসারী ছিল অমিত। যুবলীগের পরিচয় দেওয়া আরও অনেকের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে। এসব বিষয় কেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে না? কেন এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? সংগঠন হিসেবে যুবলীগ কি এর দায় এড়াতে পারে? কখনোই পারে না।

রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ও মহিউদ্দিন সোহেল

এছাড়া চট্টগ্রামে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন সোহেল হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে খোদ দলীয় প্রতিপক্ষের হাতে। মহিউদ্দিন সোহেল হত্যাকাণ্ডে ইতোমধ্যে চসিক-এর একজন কাউন্সিলর গ্রেপ্তার হয়েছেন। চাঁদাবাজির অভিযোগে তাকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে বলে প্রচার করা হলেও ইতোমধ্যে পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা হত্যা মামলায় তা ভিন্ন মোড় নিয়েছে। দিয়াজ হত্যাকাণ্ডেও অভিযোগের তীর আওয়ামী লীগ নেতাদের দিকে।

আমার নিজ জেলা ভোলায়ও এমন ঘটনা আছে। ভোলা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোস্তাক আহমেদ শাহিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু ‘পারিবারিক নেতা’র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণে বেশ কয়েকবার দলীয় নেতাদের ইন্ধনে দায়ের করা মাদক ও ডাকাতির মামলায় কারাগারে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখনও তিনি ইয়াবার মামলায় কারাগারে রয়েছেন।

আমার জানা মতে, তিনি এমন কোনো ঘটনার সাথে জড়িত নন। বাকিটা হয়তো প্রশাসন ভালো বলতে পারবে, কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগের বিষয়টা গুরুতর। ২০০১-২০০৯ মেয়াদে অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত জোট এবং ওয়ান ইলেভেন আমলে দলের দুর্দিনে ছাত্রলীগের জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করা একজন নেতা কেন এই সরকারের আমলে মিথ্যা মামলায় জেলে থাকবেন? তাকে যে কায়দায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং এর পরবর্তী ঘটনাগুলো তাদের অভিযোগগুলোকে শক্তিশালী করেছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সারাদেশে খোঁজ করলে এমন আরও হাজারো ঘটনা পাওয়া যাবে।

এসব বিষয় আমলে নিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মানুষ কিংবা বিরোধী দল তো দূরের কথা, সরকারি দলের নাম ভাঙানো এসব সন্ত্রাসীদের হাত থেকে যেন নিজেদের দলীয় নেতাকর্মীরা নিরাপদ থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যদিকে পঞ্চগড় কারাগারে নিহত আইনজীবীর বিষয়ে জেলার মুশফিকুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন: ‘বাথরুমে গিয়ে পলাশ লাইটার দিয়ে নিজের শরীরে নিজেই আগুন দিয়েছে৷ সে শরীরে আগুন লাগা অবস্থায় বাথরুম থেকে বের হয়৷ কারাগারের লোকজন আগুন নেভায়।’

বাথরুমে পলাশকে লাইটার দিয়ে নিজের শরীরে আগুন দিতে কেউ দেখেছে কিনা এবং কিভাবে দেখলো তা জানতে চাইলে তিনি বলেন: ‘না, আমি শুনেছি৷ কেউ দেখেনি৷ ধারণা থেকে বলছি৷’

পঞ্চগড় কারাগারে আগুনে নিহত আইনজীবী পলাশ কুমার রায়

নিহত পলাশের মা অবশ্য এ ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন: ‘জেলে থাকা অবস্থায় কিছু লোক আমার ছেলের সাথে দেখা করে তাকে হুমকি দিয়েছে৷ তারা তার ছবিও তুলে নিয়ে গেছে৷ আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে কারাগারের ভিতরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে৷’

হাইকোর্টের নির্দেশে অবশ্য এখন এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। অমিতের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে রিপনকে।

অমিত মুহুরী নিহত পরদিন থেকে ওই কারাগারের জেলারের ছুটি নেওয়ার ঘটনাসহ খুনী রিপনের সঙ্গে গত কয়েকদিনে কারা কারা সাক্ষাত করেছেন, কেন সাধারণ বন্দী রিপনকে ওই দিন অমিতের সেলে পাঠানো হলো, এসব বিষয় সার্বিক বিবেচনায় নিয়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

এই দুই ঘটনায় সরকারকেও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এসব ঘটনায় যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নাহলে কারাগারের মতো সুরক্ষিত জায়গায়ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে কেউ নিরাপদ থাকবে না। এছাড়া বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে নতুন নতুন শীর্ষ সন্ত্রাসীর জন্ম হবে, যে ঘোষণা ইতোমধ্যে অমিতের ভাই অনিক মুহুরী দিয়ে রেখেছেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভোলা প্রতিদিন এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)