মেজর হাফিজ সারাজীবন শুধু পেয়েই গেছেন: শাহাবুদ্দিন লাল্টু

bhola pratidin_bhola protidin_ভোলা প্রতিদিন

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ভোলা-৩ আসনের সাবেক এমপি মেজর হাফিজ সারাজীবন শুধু পেয়েই গেছেন বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শাহাবুদ্দিন লাল্টু। তিনি বলেন, সেজন্য কখনও প্রাপ্তিতে কোন ব্যত্যয় ঘটলে মেজর হাফিজ তা নিতে পারেন না।

সোমবার মেজর হাফিজের সংবাদ সম্মেলন এবং বিএনপির শোকজ বিষয়ে কথা বলেন ছাত্রদলের সাবেক এই সর্বোচ্চ নেতা। এসময় বিএনপির নেতৃত্ব এবং মেজর হাফিজের সমালোচনা করেন শাহাবুদ্দিন লাল্টু।

‘জনগণই গনতন্ত্রের শত্রু!’ শিরোনামে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‌‘‘অনেক দিন পর বিএনপি এবং তার নেতা মেজর হাফিজকে কেন্দ্র করে দুএকটি কথা বলতে চাই।

প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে। বিএনপি বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি একাই কমপক্ষে আড়াই শ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবে। এরকম নিরংকুশ বিজয়ের প্রধান কারণ হলো দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা এবং বর্তমান সরকারের অজনপ্রিয়তা।

তবে বিএনপি এবারও ক্ষমতায় গিয়ে দেশটা আগের মত করেই চালাবে বলে মনে করি। শীর্ষ নেতৃত্বের বাসার কাজের লোক এবং ব্যক্তিগত কর্মচারীরাই দেশ চালাবে। মন্ত্রী/এমপিরা দলের ত্যাগী মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জন্য কিছুই করবে না। বরং কোন বিষয় নিয়ে কর্মীরা কোন উচ্চবাচ্চ করলেই তাদেরকে মামলা হামলা ইত্যাদির মাধ্যমে নাজেহাল করবে।

বাংলাদেশে বিএনপি আওয়ামীলীগ সহ কোন দলেই কোন গণতন্ত্র নেই। সবগুলো দলেই শীর্ষ নেতানেত্রীর ইশারায় দল চলে। এ নেতানেত্রীগণ যখন যাকে খুশি পদায়ন করেন, আবার যেকোন ছুতায় যেকোন সময় ছুঁড়ে ফেলে দিতে কোন কার্পণ্য করেন না।

এসব দলের লক্ষ লক্ষ সাধারণ নেতাকর্মীও এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তারা শীর্ষ নেতানেত্রী এককভাবে যে কোন সিদ্ধান্ত নিলে সেটিকেই সঠিক মনে করেন। এটিই হলো বাংলাদেশের দল এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হবার জন্য একমাত্র দায়ি।

গণতন্ত্রের জন্য সকল পর্যায়ে আত্মসমালোচনা এবং সকলের মতামতের ভিত্তিতে দল ও দেশের জন্য যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের সুযোগ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের কোন দলেই এরকমের কোন চর্চা নেই। এর জন্য বিভিন্ন দলের শীর্ষ পদে বিগত তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে যারা ছিলেন, তারাই দায়ী।

তারা একক সিদ্ধান্তে দল চালানোর সুযোগ নিশ্চিত করার জন্যই দলে কখনই গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ রাখেননি। দলে এবং সরকারে শীর্ষ নেতানেত্রীর অতি প্রশংসা করা ছাড়া আর কিছুই নেই।

পৃথিবীর আর কোন দেশে শীর্ষ নেতানেত্রীর নামের আগে এত বিশেষন লাগানো হয় না যা বাংলাদেশে হয়। সত্যিকারের যোগ্যতা যাদের থাকে তাদের নামের আগে বেশী বিশেষণ লাগানো হলে তারা বিব্রত হন। কিন্তু বাংলাদেশে শীর্ষ নেতানেত্রীরা বিব্রত হন না।

কোন কোন বাম দলের নেতাকর্মীরা হয়তো তাদের দলে গণতন্ত্র আছে বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু সেখানে সেটি নেই। বিশেষ করে কোন একটি দলে কোন নির্দিষ্ট নেতা ৩০/৪০ বছর ধরে দলের শীর্ষ পদ ধরে রাখলে সেখানে গনতন্ত্র আছে দাবী করা যায় না।

কোন কোন শীর্ষ নেতা তার দলে তার কোন বিকল্প নেই সেরকম একটি আওয়াজ চালু রাখার চেষ্টা করেন। বিকল্প নেই এ কথাটি ঠিক নয়। ঠিকই যদি হতো তাহলে ‘চেয়ার মেইক্স এ ম্যান পারফেক্ট’ এ কথাটি প্রবাদ বাক্য হিসেবে গৃহীত হতে পারতো না। আপনি যদি আরেকজনকে সুযোগ করে না দেন, তাহলে তিনি আপনার বিকল্প হতে পারবেন কিনা তা আপনি বুঝবেন কিভাবে?

একজন মাত্র মানুষ ৩০/৪০ বছর ধরে দলের ও দেশের নেতৃত্ব নিজের হাতে ধরে রাখতে পারলে তিনি স্বৈরাচারী মনোভাবের হতে বাধ্য। আর এরকম একটি অবস্থায় দলের সকলেই যখন প্রসংসা ছাড়া কিছুই করে না, তখন হঠাৎ যদি কেউ সামান্যও সমালোচনা করতে আসে, একচ্ছত্র দলীয় ক্ষমতা ভোগকারী শীর্ষ নেতানেত্রীর পক্ষে তা মেনে নেয়া সম্ভব হয় না। আমি নিজেও যদি এরকম শীর্ষ নেতার আসনে থেকে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতাম, আমিও দলের মধ্যে কারো কোন সমালোচনা সহ্য করতে পারতাম না।

বাংলাদেশে বড় দলগুলোতে এ কথা প্রচলিত যে, শীর্ষ নেতানেত্রী কলা গাছকেও যদি মনোনয়ন দেন, জনগণ তাকেই ভোট দিবে। বিগত ৩০/৪০ বছর যাবৎ দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া জনগণ করেছেও তাই। সুতরাং বলা যায় যে, বাংলাদেশ সাধারন মানুষের শীর্ষ নেতানেত্রীর প্রতি অতি আস্থার কারণেই দেশটিতে গণতন্ত্র স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরে ন্যূনতম পর্যায়েও গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি।

এবার আসি মেজর হাফিজের প্রশ্নে। তিনি একটি অত্যন্ত মার্জিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। তার বাবা ও অনেক বড় মাপের একজন রাজনীতিক ছিলেন। এলাকায় তার এবং তাদের পরিবারের বিরাট একটি অবস্থান আছে। যতবার সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, ততবারই তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাকে কেউ হারাতে পারবে না।

কিন্তু একজন মানুষ যদি একাই এতবার এমপি হন, ঐ এলাকায় তো অন্য কেউ কোন দিন এমপি হতে পারবেন না। সুতরাং এতবার এমপি হওয়া কিংবা সুযোগ পেলেই মন্ত্রী হয়ে যাওয়া গণতন্ত্র সম্মত নয়। গণতন্ত্র মানে যখন যার যৌবন, তখন তার যৌবনকে দেশ এবং দলের জন্য কাজে লাগানো।

অভিজ্ঞতারও মূল্য আছে। সূতরাং এই মেজর হাফিজরা এতবার এমপি না হয়ে বরং টগবগে যৌবনের অধিকারী অন্যদেরকে পর্যায়ক্রমে এমপি মন্ত্রী বানিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে কাঙ্খিত গতিতে এগিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রাখতে পারতেন।

যাহোক, এবার আসি তাকে শৌকজ করার প্রশ্নে। দলের যে কাউকে দলের শৃঙ্খলা বিরোধী কাজে জড়িত হলে শৌকজ করাটা অন্যায় কোন কাজ নয়। তবে তার সাথে আমি সহমত পোষণ করে যে, যুগ্ম সম্পাদক দলের সহসভাপতিকে শৌকজ করতে পারেন না।

বিএনপিতে যখন যিনি অসম্মানিত হন, তখনই কেবল তিনি নড়েচড়ে বসেন। এই যুগ্ম সম্পাদকের প্যাডে যখন দলের মহাসচিবের নাম ঘোষণা করা হয়েছিলো তখন মেজর হাফিজ প্রতিবাদ করেননি কেন?

এই মেজর হাফিজের যেমন আছে যোগ্যতা, তেমনি তিনি সারা জীবন শুধু পেয়েই গেছেন। সেজন্য কখনও প্রাপ্তিতে কোন ব্যত্যয় ঘটলে তিনি তা নিতে পারেন না।

আমরা যখন ৯ বছর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করি, তখন তিনি এরশাদ সরকারের এমপি এবং এরশাদ নিয়োজিত ভোলা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে ক্ষমতা ভোগ করছিলেন। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েই এমপি ও মন্ত্রী হয়ে যান। তারপর এত বছর তিনি দলের কাছ শুধু পেয়েই আসছিলেন। দল বরং তিনি আসার আগে যারা তার এলাকায় দলের রাজনীতি করতেন তাদেরকে আর কোনদিনই খুঁজে দেখেনি।

মেজর হাফিজ সংস্কারপন্থী হয়ে সেনাসমর্থনে দলের মহাসচিব হয়েছিলেন যা দলের সাধারণ নেতাকর্মীদেরকে মর্মাহত করেছে। সেই তিনিই যখন ইমার্জেন্সী সরকার পরবর্তী বিএনপিতে ফিরে এসে দলের বড় একটি পদ পেয়ে গেলেন, অনেকেই অবাক হয়েছে। আর এতে যিনি তাকে এ পদে বসিয়েছিলেন, তার উপরও দলের অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছে।

আমার মনে হয় মেজর হাফিজের সাথে ইমার্জেন্সী সরকারের আমলেও দলের মূলস্রোতের শীর্ষ নেতার ভাল রকমের একটা যোগাযোগ ছিলো। যদি তা না থাকতো, এ মেজর হাফিজ ঐ সময় সেনাসমর্থিত বিএনপির মহাসচীব হওয়া এবং একই সমর্থনে দলীয় কার্যালয় দখলে যাওয়ার পরও তিনি কিভাবে পরবর্তীতে রাতারাতি দলে ফিরে এসে পদ এবং মনোনয়ন সবই পেলেন?

তবে মেজর হাফিজের মত এত শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ একজন রাজনীতিকের মুখে এটা শোভা পায়নি যে, তিনি ইমার্জেন্সী সরকারের সময় বারবার সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তারা বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যায়। যদি তিনি তা বলেও থাকেন, প্রকাশ্য এ কথাটি সাংবাদিকদের সামনে বলে দেয়া তার ঠিক হয়নি। এতে শুধু তার দলই নয়, তিনি নিজেও ছোট হয়েছেন।

তিনি দলের শীর্ষ নেতানেত্রীকে ছোট করে এবার কোন কিছু বলেছেন কি না তা আমি জানি না। কিন্তু ২০/২২ আগেই তার এলাকা লালমোহনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল করা একজন নেতার কাছ থেকে শুনেছি তিনি বিভিন্ন সময় তার এলাকায় নেতাকর্মীদের সাথে এমন ভাবে কথা বলতেন যাতে তিনি বুঝাতে চেষ্টা করতেন যে, তিনি এমন কি বেগম জিয়াকেও তেমন একটা কেয়ার করেন না।

আরেকটি কথা। মেজর হাফিজ প্রায়ই বলেন তিনি সহ অল্প কজনে মিলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ক্রিয়েইট করেছিলেন। এটা যদি সত্যিও হয়ে থাকে, তার এভাবে প্রকাশ্যে বলা উচিৎ নয়। কথাটিতে অতি অহংকার প্রকাশ পায়। এদিকে আর্মি এমন কি তিনি নিজেও ছোট হন।

অবশেষে বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতানেত্রীকে শুধু এটুকুই বলবো যে, নিজের ক্ষেতে ফসল ফলিয়ে সে ফসল খেতে যে মজা, সে মজা কিন্তু অন্য কোন ফলে পাওয়া যায় না তা পৃথিবীর যে দেশ থেকেও আনা হোক না কেন। দলের নিজস্ব সৃষ্টি শত অপমান অপদস্ত, আর বন্চনার পরও দিন শেষে যেমন নিজের দলের পক্ষেই থাকে, আজ এ দল কাল ঐ দল করা লোকেরা সেরকম হয় না।

এ সুযোগে দেশের রাজনীতি নিয়ে অল্প একটু কথা বলে শেষ করবো। অন্য যে কোন মানুষের মত আমি নিজেও আমার দেশকে যারপর নাই ভালবাসি। ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে এ দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু যে কারনে তারা দেশটাকে স্বাধীন করেছেন, ২/৪ বছর ছাড়া বিগত ৫০ বছরে দেশটিতে তার কোন বাস্তবায়ন তো ঘটেইনি, বরং দেশটিতে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে খারাপ অবস্থা বিরাজ করেছে। এতগুলো বছর এ দেশে যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া, যেতে পারলে যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থেকে যাওয়া, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদেরকে গুমখুন করে পুলিশ কর্তৃক ক্রসফায়ার বলে চালিয়ে দেয়া, নির্বাচনের আগের রাতে ভোটের কাজ শেষ করা, বিচার বিভাগ এবং সংবাদপত্রের টুটি চেপে ধরা, যে যত বড় নেতা সে তত বেশী মিথ্যা কথা বলা ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। আর দেশের মানুষও যেন এতেই সন্তুষ্ট। সুতরাং আমি আমার প্রিয়ে বাংলাদেশের ভালো কোন ভবিষ্যত দেখতে পাই না। অন্ত:ত আমার জীবদ্দশায় সেরকম কোন আশাই আমি করতে পারি না।

কোন একটি কবিতায় একটি নদকে বলতে শুনেছি, ‘ম্যান মেই কাম এ্যান্ড ম্যান মেই গৌ, বাট আই গৌ অন ফর এভার এ্যান্ড ফর এভার।’ একই ভাবে বাংলাদেশে সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু রাজনীতি এবং অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে যারা নেতৃত্বে থাকবেন অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের কারো চরিত্রে তেমন কোন পরিবর্তনই আসবে বলে আমি মনে করি না। আর আবারও বলতে চাই বাংলাদেশে বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতাত্রীর প্রতি নিজ নিজ দলের সাধারণ কর্মী এবং সমর্থক তথা জনগনের অন্ধ ভালবাসা ও বিশ্বাসই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ি। সুতরাং বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার জন্য জনগনই দায়ি। অর্থাৎ বুঝে হোক আর না বুঝে হোক, জনগণই গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু।