রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হয়েছি: সাহাবুদ্দিন লাল্টু

দ্বীপজেলার একটি গ্রাম থেকে উঠে এসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। রাজনীতি কিংবা ছাত্ররাজনীতির সাথে যারা জড়িত তারা নির্দ্বিধায় এটা স্বীকার করবেন। যে ক’জন ছাত্রনেতা এ অসাধ্য সাধন করেছেন তার মধ্যে একজন ভোলা জেলার সন্তান মো. সাহাবুদ্দিন লাল্টু।

ভোলার এই কৃতি সন্তান দীর্ঘদিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছেন। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে খুব কাছে থেকে দেখেছেন দেশ পরিচালনার যাবতীয় বিষয়। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হিসেবে সাংগঠনিক দক্ষতায় স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতির অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণও করেছেন তিনি। এরপরও জাতীয় রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে সাহাবুদ্দিন লাল্টুকে।

ছাত্রদলের সাবেক এই সভাপতি বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন। সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজ এবং দলের কিছু অনিয়মের বিরুদ্ধে সোজাসাপ্টা কথা বলে তিনি এখন আলোচনায়। যদিও অনেক আগে থেকেই তিনি সরাসরি ন্যায়সঙ্গত কথা বলে আসছেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদল এর সাবেক এই সভাপতির সাথে কথা হয় ভোলা প্রতিদিন এর।

সাংগঠনিক দক্ষতায় একসময় ছাত্রদলকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেও এখন কেন রাজনীতি ছেড়ে কানাডায় অবস্থান করছেন? ভোলা প্রতিদিন এর এমনই তীর্যক প্রশ্ন ছিল মো. সাহাবুদ্দিন লাল্টুর কাছে। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপি এবং বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, রাজনীতি ছেড়ে দেশের বাইরে চলে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে।’

এই সাবেক ছাত্রনেতা বলেন, সন্তান লালন-পালনের পর পড়ালেখা করে বড় হলেও পিতামাতা অর্থাৎ অভিভাবকদের আরও কিছু দায়িত্ব থাকে। সেসব দায়িত্ব অভিভাবকদের পালন করতে হয়। তাহলে সন্তানও যেমন ভালো থাকে, পিতামাতার জন্যও সেটা গৌরবের। ঠিক একইভাবে ছাত্ররাজনীতি করে আসা নেতাকর্মীদের যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযথ জায়গায় দায়িত্ব দিয়ে বসানো মূল দলের নেতাদের নৈতিক দায়িত্ব। এতে দল যেমন উপকৃত হয়, নেতাকর্মীরাও বিপুল বিক্রমে উৎসাহী ও কর্মোদ্যমী হন। বিএনপিতে সেটা হয়নি। মূল দলের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও ভোলা জেলার সংসদ সদস্য সিনিয়র বড় ভাইরাও সেটা করেননি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও সেটা করেননি। ওনাকে আমি বলেছি, ম্যাডাম অন্য ছাত্রনেতাদের আপনি যেভাবে যা দিয়েছেন আমাকেও আপনি সেভাবে দেখেন। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না।

‘‘কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তৃণমূল পর্যায় থেকে ছাত্রদলের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও মূল দলে বা অন্য কোথাও কোনো পদপদবি বা রাজনৈতিক মূল্যায়ন পাইনি। শুধু আমি নই, ছাত্রদল করা আরও অনেক নেতাকর্মীকে এভাবে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছিল। অথচ একই সময়ে বিএনপির বিভিন্ন নেতার কাজের লোকজনও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছিল। ছাত্রদল বা অন্য অঙ্গসংগঠনের যারা তেমন কোনো যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারছিলেন না শুধু নেতৃবৃন্দের ফরমায়েশ খেটে নিজেকে তাদের লোক হিসেবে প্রমাণিত করে দলের পদপদবি পাচ্ছিল।

এছাড়া আমার কর্মী এবং যাদের হাতে হাত রেখে একসাথে রাজনীতি করেছি তারা যদি পদ-পদবী পেয়ে ভালো অবস্থানে যান তবে সেটা আমার জন্য অবশ্যই গৌরবের। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কয়েকদিন আগেও যারা আমার কর্মী ছিলেন তাদের কাছে এত কম সময়ের ব্যবধানে আমাকে পদ-পদবীর জন্য ধর্ণা দিতে হবে। পরিস্থিতি এমন মনে হচ্ছিল যে– আরও কিছুদিন গেলে তাদের কাছে গিয়ে আমার বসে থাকতে হতো। এমন অবস্থায় কি আমি রাজনীতি করতে পারি? আর দলীয় হাইকমান্ডকে এসব বলতে হবে কেন? ছাত্রনেতাদের সবাইকে যথাযথ জায়গায় বসিয়ে রাজনীতি করতে দেওয়া তো তাদের দায়িত্ব ছিল’’, ভোলা প্রতিদিনকে বলছিলেন সাহাবুদ্দিন লাল্টু।

‘এখন তো দলের দুর্দিন। ছাত্রদলের ত্যাগী নেতারা কি এ অবস্থা থেকে দলকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে না? তাদের কি এগিয়ে আসা উচিৎ নয়?’ ভোলা প্রতিদিন এর এমন প্রশ্নের জবাবে মো. সাহাবুদ্দিন লাল্টু বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই এগিয়ে আসবে। এগিয়ে আসা উচিৎ। কিন্তু বিএনপি সরকারি দলে থাকতে যোগ্যতাসম্পন্ন নেতাকর্মীদের সাথে যে আচরণ করেছে, এত বছর বিরোধী দলে থেকেও কি সেই অবস্থার উন্নতি করতে পেরেছে? পারেনি। ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীদের কি তারা এখনও ওউন করে? করে না। অর্থাৎ বিএনপির দলছুট নেতারা তখনও কাজের লোকদের নেতা বানানোর প্রক্রিয়ায় ছিলেন, এখনও সেই পথেই আছেন। তাহলে ত্যাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন নেতারা কীভাবে আসবেন? এজন্যই বিএনপি এখন এমন করুণ দশায় পতিত হয়েছে। এসব দেখে জাতীয়তাবাদী আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে কষ্ট লাগে ঠিকই, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।’bhola pratidin_bhola protidin

বিএনপিতে সরাসরি অনেক কঠিন কথা বলার জন্যও পরিচিত সাহাবুদ্দিন লাল্টু। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আত্মসমালোচনা আমি করি। দলে যারা নানা বিষয়ে কথা বলার সাহস রাখেন তারা সাহসী। এটা শুধু বিএনপির জন্য প্রযোজ্য নয়। যেকোন রাজনৈতিক দলের জন্যই এটা প্রযোজ্য। যেসব নেতাকর্মীরা দলেই কথা বলার সাহস রাখেন না, তারা বিরোধী পক্ষের নানা অনিয়ম নিয়ে রাজপথে নামতে পারেন না। তারা সবক্ষেত্রেই সুবিধাবাদী। রাজপথে লাঠি, বুলেট আর জলকামান দেখলে সে ভয় পাবেই। এজন্যই সততার প্রতীক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া জনপ্রিয় দল বিএনপির আজ করুণ দশা।

বিএনপি তার হাতে গড়া সন্তানদের প্রকৃত মূল্যায়ন না করে সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের দিনের পর দিন সুবিধা দিয়ে আসছে। অথচ অন্য দল থেকে আসা সেই সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা বিএনপিকে ধারণ করেন না। সুযোগ পেলেই বিএনপি এবং জিয়া পরিবারের সাথে বেইমানি করতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু ছাত্রদল করে আসা তেমন কোনো নেতা এটা করেন না। মা-বাবার সাথে কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হলেও নিজের সন্তান যেমন মা-বাবাকে ছেড়ে অন্য কাউকে মা-বাবা বানায় না, ঠিক তেমনই ছাত্রদল করা কোনো নেতাকর্মী দলের নানা অনিয়মের সমালোচনা করলেও বিএনপি ছেড়ে কোথাও যায় না। কিন্তু স্বার্থে আঘাত আসলেই সুবিধাবাদী নেতারা সুযোগ পেলেই দল ও সর্বোচ্চ নেতাদের সাথে বেইমানি করে।

সাহাবুদ্দিন লাল্টু অর্থনীতির একটি সূত্র উল্লেখ করে বলেন, ‘অর্থনীতিতে কস্ট এবং বেনিফিট বলতে একটা বিষয় আছে। ব্যবসায়ীরা যেকোন বিজনেসের শুরুতেই চিন্তা করেন এতে কস্ট এর পরিমাণ এবং বেনিফিট কত? কস্ট এর চেয়ে বেনিফিট বেশি হলে তারা সেখানে বিনিয়োগ করে থাকেন বা সেই বিজনেসে হাত দেন। ঠিক একইভাবে যোগ্য নেতাকর্মীদের সমালোচনাটুকু কস্ট হিসেবে ধরা যায়। কিন্তু সেই একই নেতা যখন নিজের সাংগঠনিক দক্ষতায় রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে দলকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করেন সেটাকে বেনিফিট ধরতে পারেন। এখানে কস্ট এর অনুপাতে বেনিফিট বেশি। সুতরাং নিজ দলের দক্ষ ও যোগ্য নেতারা যথাযথ জায়গায় থাকলে সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দ এর সুফল ভোগ করেন। কিন্তু সুবিধাবাদী লোকদের দিয়ে পদবীগুলো ধরে রাখলে এতে সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের আদতে কোনো লাভ হয় না। দেশও উপকৃত হয় না। তবে এটা তারা খুব শিগগির বুঝবেন বলেও আমার মনে হয় না।’

ভোলা জেলার বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোলা জেলা বিএনপিতে প্রয়াত শাহজাহান ভাইয়ের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমিও অস্বীকার করি না। কিন্তু শাহজাহান ভাইয়ের সন্তান কিংবা ভাই পরিচয়ে কেউ সর্বোচ্চ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা কিংবা পৌরসভার চেয়ারম্যান হতে পারেন। তাই বলে এই পরিচয়ে কেউ দল পরিচালনার দায়িত্ব পেতে পারেন? কারণ, দল পরিচালনা কোনো আবেগের বিষয় নয়। শাহজাহান ভাইয়ের যে যোগ্যতা ছিল, সেই যোগ্যতা তার ভাই কিংবা সন্তানের কি আছে? দল পরিচালনা করবে দক্ষ ও ত্যাগী নেতারা। কিন্তু ভোলা জেলা কিংবা সদর বিএনপিতে সেটা হচ্ছে না।

এছাড়া আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ ভাইয়ের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো সাংগঠনিক দক্ষতা ও অবস্থান তাদের নেই। এসব কারণে বিএনপির এক সময়ের দূর্গ এখন হাতছাড়া। এ অচলাবস্থা নিরসনে ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের হাতে দল পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও একইভাবে যোগ্যদের মনোনয়ন দিতে হবে। নয়তো দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নয়ন হবে না।

একইসঙ্গে ভোলার উন্নয়নে সকল ভেদাভেদ ভুলে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করা উচিৎ বলেও ভোলা প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে আহ্বান জানিয়েছেন ভোলা জেলার সন্তান ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মো. সাহাবুদ্দিন লাল্টু।