ভোলা প্রতিদিন এর সহায়তায় ১৩ বছর পর বাবার ভিটায় ফিরল রুবেল

ঈদুল ফিতরের দিন। সকাল ১০টা। ঈদের নামাজ পড়ে চা খাওয়ার জন্য লালমোহন উপজেলার ডাওরী বাজারে আসি। চা খেতে বসার পর পাশের দোকান থেকে ১৫-২০ জন লোক একটা অপরিচিত ছেলেকে আমার কাছে নিয়ে এলো। এসে তারা বললো, এই লোকটা তার বাড়ির ঠিকানা জানে না।

সেই ছেলের কাছে গিয়ে প্রথমে তার নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো তার নাম রুবেল, পিতা শাহজাহান, বাড়ির নাম বিলের বাড়ি। কোন জায়গায় বলে পুরান ডাওরী বিলের বাড়ি। ঠিকানা এর বেশি জানে না সে। পরে রুবেল তার জীবনের পুরো ঘটনা বললো।

সে জানায়, দুধের শিশু থাকতে তার মা বিষপান করে মারা যায়। বাবা আরেকটি বিয়ে করে। সৎ মায়ের কাছে ওকে রেখে চট্টগ্রাম কাজ করতে যায়। রুবেলের বয়স যখন ৭ বছর তখন তার বাবা চট্টগ্রাম মারা যায়। বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে বড়বোন পাখি ওকে সাথে নিয়ে বাবার লাশ দেখতে চট্টগ্রাম যায়। পরে বোন সহকারে চট্টগ্রাম ফিশারী ঘাট থাকে। সেখানে অভাবের সংসারে দুলাভাই ঠিকমতো নিচ্ছিল না তাকে। এর কিছুদিন পর বাসা থেকে বের হয়ে আর চিনে আসতে না পেরে ট্রেনে উঠে অজানা গন্তব্যে পাড়ি দেয় রুবেল। ট্রেন থেকে ওকে নামিয়ে দিলে সেখানে বিভিন্ন চায়ের দোকানে কাজ করে পেট চালায়।

১৩ বছর পর এমন কথা শুনে ওকে একা ছেড়ে দিতে পারিনি। ঈদের দিন ব্যস্ততা ও সামাজিক অনুষ্ঠান ছিল। তবে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে একা ছেড়ে দেব না। যেই ভাবা সেই কাজ। ওকে নিয়ে পুরো দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম। নাম-ঠিকানা পুরোপুরি বলতে না পারায় ঘুরতে ছিলাম। একপর্যায়ে গেলাম তজুমদ্দিনের ডাওরী এলাকায়। সেখানে গিয়েও মিলল না এমন কোনো ঠিকানা।

একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থা! তবে হাল ছাড়িনি। শেষ চেষ্টা হিসেবে তজুমদ্দিন নতুন বাজার এলাকায় আমার এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে ওর নাম ঠিকানা বললাম। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল সেখানকার কোড়ালমাড়া গ্রামে বিলের বাড়ি নামে একটি বাড়ি আছে। আরও জানা গেল ওই বাড়ির এক শাহজাহান ১৩ বছর আগে চট্টগ্রামে মারা গেছে। তার এক ভাই ছিল ছলেমান নামে, সেও মারা গেছ। এখন তার ছেলে সুমন হোটেল ব্যবসা করে। এবার যেন একটা আশার আলো দেখা গেল।

এরপর সেখানে রুবেলকে নিয়ে যাই। প্রথমে সুমন বলে, তার এমন কোনো চাচাতো ভাই নাই। বাবা-মা হারানোর পর হারিয়ে যাওয়া একটি ছেলের শেষ আশার আলোও যেন নিভতে যাচ্ছিল। কিন্তু আল্লাহ যাকে বাবার ভিটায় ফেরত পাঠাবেন, তাকে কি আর কেউ ঠেকাতে পারে? রুবেলের চাচাতো ভাইয়ের অস্বীকার করার পরিপ্রেক্ষিতে কথাবার্তার একপর্যায়ে এমন একটি সংবাদ শুনে অনেক মানুষ আসে। ওকে দেখে চিনতে পারে।

এরপর আমি ওর বোনের নাম্বার নিয়ে তার সাথে কথা বলি। সেও তার ভাইকে চিনতে পারে। এরপর তার বোন বলল রুবেলকে তাদের খালুর কাছে দিয়ে আসতে। এমন অবস্থায় তার খালুকে খবর দেই। অবশেষে তার খালু ও চাচতো ভাই সুমনের কাছে তাকে দিয়ে আসি। এভাবেই ১৩ বছর পর ঠিকানা খুঁজে পেল রুবেল। আর এতেই যেন ঈদের দিনের যাবতীয় অনুষ্ঠান বাতিলের পরও আমাদের ঈদ আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠলো।