সেনা অভ্যুত্থানে ফের অন্ধকার যুগে মিয়ানমার

সোমবার এক সেনা অভ্যুত্থানে ফের অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো মিয়ানমার। দেশটি এর আগেও যদিও সেনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল না, তবুও আজ গণতন্ত্রপন্থী অং সান সু চি এবং প্রেসিডেন্টসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে অন্ধকার যুগে পা রাখলো।

মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে বিরোধ তৈরির পর এ ঘটনা ঘটলো। দেশটি এখন পুরোপুরি সেনা নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চি এবং অন্যান্য নেতাদের আটকের পর এই তথ্য নিশ্চিত করেছে সেনাবাহিনী।

এর আগে ২০১১ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল মিয়ানমার। গত নভেম্বরের নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকার গঠন করার জন্য যথেষ্ট আসন লাভ করে। কিন্তু সেনাবাহিনীর দাবি ওই নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে।

সেনা অভ্যুত্থান প্রতিরোধের ডাক সু চি’র
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে জনগনকে রাস্তায় নামার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন অং সান সুচি। অং সান সুচির দল এনএলডি তাদের ফেসবুকে এক বিবৃতিতে সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে।

রয়টার্স জানায়, সামরিক জান্তাদের হাতে বন্দী নেত্রীর পক্ষে এই বিবৃতি দেয়া হয়েছে। নভেম্বরের নির্বাচনের আগে প্রচারণার জন্য যে ফেসবুক একাউন্ট তারা ব্যবহার করতো সেখানেই বিবৃতিটি পোস্ট করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীর এই ভূমিকা দেশকে একনায়কতন্ত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। জনগণকে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি, তারা যেন এটা মেনে না নেয়। তারা যেন সেনাবাহিনীর এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।

বিবৃতিটির নিচে অং সান সুচির নাম থাকলেও তার কোনো স্বাক্ষর ছিলো না। তবে সেখানে এনএলডির চেয়ারম্যান উইন টিনের হাতে লেখা একটি নোট দেখা গেছে। যেখানে তিনি বলেছেন, এই বিবৃতি সুচির ইচ্ছার প্রতিফলন এবং এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

তিনি আরও লিখেন, আমি কসম করে বলছি, অং সান সুচি নিজে জনগণের প্রতি এই আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্বব্যাপী কড়া প্রতিক্রিয়া
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চি-সহ অন্য নেতাদের আটকের ঘটনায় কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিশ্ব নেতৃত্ব।

জাতিসংঘ
মিয়ানমারের ঘটনায় গভীর নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ। আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সব ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে চলে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্থাটি।

জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের একজন মুখপাত্রের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনা দেশটির গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন বিপর্যস্ত করবে। সেনা নেতৃত্বকে মিয়ানমারের জনগণের চাওয়াকে শ্রদ্ধা জানানোর এবং গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে চলার আহ্বান জানায় জাতিসংঘ।

গণতন্ত্র, শান্তি, মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ মিয়ানমারের জনগণের পাশে আছে বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।

বাংলাদেশ
সেনা অভ্যুত্থানে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি-সহ অন্য শীর্ষ নেতাদের আটকের ঘটনায় সেখানকার পরিস্থিতি ‘পর্যবেক্ষণ’ করছে বাংলাদেশ।

সোমবার এ নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই গণতান্ত্রিক সরকারের প্রত্যাশা রাখে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেবে ঢাকা।

প্রতিবেশি দেশটির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে শুধু বেসামরিক সরকারই নয় দেশটির সেনাবাহিনীর সাথেও কূটনৈতিক দেনদরবারে রয়েছে ঢাকা। ইতিহাস বলে দেশটির সামরিক শাসনের আমলেই রোহিঙ্গাদের দু’দফায় প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়েছিল।’

যুক্তরাষ্ট্র
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি ও অন্যান্য নেতাদের দ্রুত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অভ্যুত্থানের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনীকে কড়া সতর্ক বার্তা দিয়েছে দেশটি।

হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেন সাকি এক বিবৃতিতে বলেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল বদলের চেষ্টার বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। আর যদি এসব পদক্ষেপ ফিরিয়ে না নেওয়া হয় তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আমরা সেনাবাহিনী ও অন্যান্য দলগুলোকে গণতন্ত্রের নিয়ম ও আইনের শাসন মেনে চলার আর যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি।

চীন
চীন তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, সবই তাদের নজরে আছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, চীনের বন্ধু প্রতিবেশি মিয়ানমার। আশা করি সব পক্ষই সংবিধানের ভিত্তিতে নিজেদের পার্থক্য মানিয়ে নেবে এবং স্থিরতা নিশ্চিত করবেন। এখনও পরিস্থিতি আরো বেশি বোঝার পদ্ধতিতে আছে বলেই জানিয়েছে চীন।

ভারত
মিয়ানমারের ঘটনায় প্রতিবেশী দেশ ভারত গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গভীর উদ্বেগের সাথে মিয়ানমারের বিষয়গুলো দেখছি আমরা। আমাদের বিশ্বাস আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবশ্যই পালন করা হবে। আমরা খুব কাছ থেকে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছি।

আসিয়ান
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ানের কয়েকটি দেশ তাদের সদস্য মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানকে ‘অভ্যন্তরীণ‘ ব্যাপার বলে বিবেচনা করছে। জোটের পক্ষ থেকে অথবা সদস্য দেশগুলোর পক্ষ থেকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সরাসরি কোনো নিন্দা করা হয়নি।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দিশের এই জোটের বর্তমান চেয়ারম্যান ব্রুনেই এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই জোট আশা করে জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান রেখে সংলাপের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।“ আসিয়ান চেয়ারম্যানের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “আমরা আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আসিয়ান জোটের সদস্য দেশগুলোতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এই এলাকার শান্তি এবং সমৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।“

তবে আসিয়ানের তিনটি সদস্য দেশ – ক্যাম্বোডিয়া, ফিলিপিন্স এবং থাইল্যান্ড – খোলাখুলি বলেছে, মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা তাদের একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এ নিয়ে তাদের কিছু বলার নেই।

মিয়ানমারের ২৪ মন্ত্রী বরখাস্ত, শূন্য পদে বেশিরভাগই সেনা অফিসার
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের প্রথমে দিনেই ক্ষমতাচ্যুত অং সান সুচির সরকারের অধিকাংশ সদস্যকে বরখাস্ত করে নতুনদের নিয়োগ দিয়েছে।

রয়টার্স জানায়, সু চি সরকারের ২৪ জন মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেই সাথে নতুন ১১ জন মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে ।

নুতন মন্ত্রীদের অধিকাংশই সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা। কয়েকজন রয়েছেন সেনা সমর্থিত দল ইউএসডিপির সদস্য। ইউএসপিডির অন্যতম নেতা উনা মং লউনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি নভেম্বরের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন।

সেনাবাহিনী পরিচালিত টেলিভিশনে নতুন এসব নিয়োগের ঘোষণা দেয়া হয়।